সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০২০

মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ বা মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সম্পর্কে হিন্দুশাস্ত্র কী বলে? এ বিষয়ে হিন্দু বিজ্ঞানীদের কোন অবদান আছে কি?

*মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ বা মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সম্পর্কে হিন্দুশাস্ত্র কী বলে? এ বিষয়ে হিন্দু বিজ্ঞানীদের কোন অবদান আছে কি?

আধুনিক বিশ্বে সকলের ধারণা মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ শক্তি নিউটন প্রথম আবিষ্কার করেছেন। অনেকেই জানেন না যে, এ বিষয়ে হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদ-এ স্পষ্টভাবে আলোচনা হয়েছে।
সবিতা যন্ত্রৈঃ পৃথিবী মরভণাদস্কম্ভনে সবিতা দ্যামদৃংহৎ। অশ্বমিবাধুক্ষদ্ধু নিমন্তরিক্ষমতূর্তে বদ্ধং সবিতা সমুদ্রম।। ঋগে¦দ ১০/১৪৯/১
“সূর্য্য রজ্জুবৎ আকর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে। নিরাধার আকাশে দ্যুলোকের অন্যান্য গ্রহকেও ইহা সুদৃঢ় রাখিয়াছে। অচ্ছেদ্য আকর্ষণ রর্জ্জুতে আবদ্ধ, গর্জনশীল গ্রহসমূহ নিরাধার আকাশে অশ্বের ন্যায় পরিভ্রমণ করিতেছে।”

দেখুন, আকাশ যে নিরাধার এবং রজ্জুবৎ আকর্ষণ অর্থাৎ মহাকর্ষ শক্তির দ্বারাই যে সেই নিরাধার আকাশে সূর্য ও গ্রহসমূহ নিজ অক্ষরেখায় সুদৃঢ় রয়েছে -এখানে সেকথা বলা হয়েছে। 
বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক ধর্মগ্রন্থে আকাশকে স্পষ্টভাবে পৃথিবীর ছাদ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ এই সব ধর্মমতের জন্মেরও হাজার বছর পূর্বে বেদ-এ আর্য ঋষিগণ আকাশকে নিরাধার অর্থাৎ পৃথিবীকে ও গ্রহসমূহকে শূন্যে ভাসমান বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। আরও লক্ষ্যণীয়, মহাকর্ষ শক্তিতে আবদ্ধ গ্রহসমূহ যে নিরাধারে অর্থাৎ মহাশূন্যে স্থির নয়, বরং পরিভ্রমণ করছে নিজ কক্ষপথে -এই জ্ঞানও আবিষ্কার করেছিলেন বৈদিক ঋষিগণ। 

এমনকি সূর্য নিজেও যে তার নিজস্ব কক্ষপথে চলছে সেই অত্যাশ্চর্য গূঢ় বিজ্ঞানও আলোচিত হয়েছে নিম্নের মন্ত্রে:
আকৃষ্ণেন রজসা বর্তমানো নিবেশয়ন্নমৃতং মর্তঞ্চ। 
হিরণ্ময়েন সবিতা রথেনা দেবো যাতি ভুবনানি পশ্যন্।। ঋগে¦দ ১/৩৫/২
“সূর্য্য আকর্ষণযুক্ত পৃথিব্যাদি লোক-লোকান্তরকে সঙ্গে রাখিয়া নশ্বর-অবিনশ্বর উভয় পদার্থকে নিজ নিজ কার্যে নিযুক্ত রাখিয়া এবং মাধ্যাকর্ষণ রূপে রথে চড়িয়া যেন সারা লোকান্তর দেখিতে দেখিতে গমন করিতেছে।”
খুব অবাক হতে হয়, পৃথিবী যেমন চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে, তদ্রƒপ সূর্যও যে তার গ্রহ-উপগ্রহসমূহকে সঙ্গে নিয়ে নিজের কক্ষপথে গমন করছে -এই গভীর জ্ঞানও পবিত্র বেদ-এ আলোচিত হয়েছে।
মহাবিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য্য (১১৫০ খ্রিঃ) তাঁর সিদ্ধান্ত শিরোমণি নামক জ্যোতিঃশাস্ত্রের গোলাধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন- 
“আকৃষ্টি শক্তিশ্চ মহী তয়া যৎ স্বস্থং স্বাভিমুখী করোতি। 
আকৃষ্যতে তৎ পততীব ভাতি সমে সমন্তাৎ কুবিয়ং প্রতীতিঃ।।” 
অর্থাৎ “সর্ব পদার্থের মধ্যে এক আকর্ষণ শক্তি বিদ্যমান রহিয়াছে, যে শক্তি দ্বারা পৃথিবী আকাশস্থ পদার্থকে নিজের দিকে লইয়া আসে। যাহাকে ইহা আকর্ষণ করে তাহা পতিত হইল বলিয়া মনে হয়।”
অর্থাৎ প্রাচীন ঋগে¦দ শাস্ত্রের পাশাপাশি ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করলেও হিন্দু বিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য্য (১১১৪-১১৮৫) বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের (১৬৪২-১৭২৭) জন্মেরও কমপক্ষে পাঁচশত বছর পূর্বে মহাকর্ষ শক্তি আবিষ্কার করে তার গ্রন্থ সিদ্ধান্ত শিরোমণিতে আলোচনা করে গিয়েছেন।









 *প্রথম আধুনিক বিমান

আধুনিক পৃথিবীর প্রথম বায়ু অপেক্ষা ভারী বিমান কখন উড়ানো হয়, এই প্রশ্ন করলে আপনি হয়ত বলবেন, ১৯০৩ সালের রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের উড়ানো বিমান। কিন্তু যদি বলি, না, রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের ৮ বছর আগে একজন ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃত পন্ডিত মানববিহীন বায়ু অপেক্ষা ভারী প্লেন উড়ান এবং তা রাইটদের প্লেনের চেয়ে অনেক বেশি দূর উড়েছিল বিশ্বাস করবেন?
শিবকর বাপুজি তালপাড়ে ১৮৬৪ সালে মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সংস্কৃতের পন্ডিত ছিলেন। তাহলে প্লেন বানালেন কি করে?

ছোটবেলা থেকেই ঋষি ভরদ্বাজ রচিত 'বৈমানিক শাস্ত্রের' প্রতি তার খুব আগ্রহ ছিল। ভরদ্বাজ একজন বৈদিক ঋষি যার 'বৈমানিক শাস্ত্রের' এক অংশ এখন পাওয়া যায়। বর্তমানে প্রাপ্ত বৈমানিক শাস্ত্রে ৩০০০ হাজার শ্লোক আছে যেখানে বিভিন্ন ধরনের বিমানের গঠনপ্রণালী, জ্বালানী ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থে পারদের আয়নকে সূর্যের আলোর শক্তির সাহায্যে কাজে লাগিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার কথা রয়েছে। নাসা এটা নিয়ে কাজ করছে এবং এ জ্বালানির ব্যবহারে মিনিটে ১২০০-৩০০০ কিমি গতি তোলা সম্ভব বলে জানা যায়। বৈমানিক শাস্ত্রকে অনুসরণ করে শিবকরজী মরুৎসখা (বায়ুর সখা) বা মতান্তরে মরুৎশক্তি (বায়ুর শক্তি) বিমান তৈরী করেন। বারোদার রাজা H H Sayaji Rao Gaekwad তাকে এই কাজে সহায়তা করেন। অবশেষে মুম্বাইয়ের চৌপথি বীচে ১৮৯৫ সালে বারোদার রাজা, তৎকালীন বিখ্যাত বিচারক, জাতীয়তাবাদী গোবিন্দ রানাদে এবং অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর সামনে মরুৎসখা বিমান উড়ানো হয় যা ১৫০০ ফুট দুরত্বে যায়।

ভাবতে পারেন, হিন্দুরা বিমান আবিষ্কার করলে তা এগুলো না কেন? একজন হিন্দুর এই আবিষ্কার ইংরেজ শাসকদের পছন্দ হয়নি। শাসকদের আদেশে বারোদার রাজা শিবকরজীকে সাহায্য করা বন্ধ করতে বাধ্য হন। বানানো বিমানটাকে বিদেশে পাচার করে দেয়া হয়। এভাবেই শিবকরজীর গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তার এই অবদানস্বরূপ তাকে বিদ্যা প্রকাশ প্রদীপ উপাধী দেন ভারতীয় পন্ডিতেরা। শিবকরজী ১৯১৬ সালে পরলোকগমন করেন।









 *আধুনিক বিজ্ঞানের বিষ্ময়: অথর্ব বেদের বাস্তুবিদ্যা বা বাস্তুশাস্ত্র

বাস্তু বিদ্যা হল এক গভীর জ্ঞান যার মাধ্যমে পাওয়া তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করে বানানো বা সাজানো যে কোন স্থাপনা এনে দিতে পারে সুস্বাস্থ্য ও অনেক শুভফল। বাস্তু শাস্ত্র হল এই ভারতবর্ষের এক সুপ্রাচীন স্থাপত্য বিষয়ক ফলিত ও কারিগরী বিদ্যা। এর ভিত্তি ছিল সুপ্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভৌগোলিক অবস্থা ও জলবায়ু। সনাতন ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদের অংশবিশেষ হল এই বাস্তু শাস্ত্র যা চার হতে পাঁচ হাজার বছর প্রাচীন। অথর্ব বেদের একটি অংশ হলো স্থাপত্য বেদ। এই স্থাপত্য বেদ হতেই বাস্তু বিদ্যা বা স্থাপত্য বিজ্ঞানের অবতারণা। মূলত হিন্দু মন্দির ও ধর্মীয় স্থাপত্যগুলো এই রীতিতে নির্মিত হলেও বিশাল প্রেক্ষাপটে তা বসবাসের গৃহ নির্মাণেও ব্যবহৃত হতো। এই শাস্ত্রটি মূলত স্থপতি ঋষিদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল, আর তাদের শিষ্যদের তা অধ্যয়নের ও সংশোধনের অধিকার ছিল। প্রতিটি সংশোধনের জন্য যথার্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অত্যন্ত গভীর পর্যবেক্ষণ করে সর্বসম্মতভাবে সংশোধন করা হতো। বাস্তু শব্দটি এসেছে বস্থ থেকে- বস্তু মানে যেকোনো বস্তু; মূলত বাস্তু বলতে সব কিছুকেই বুঝায়- তা একটি স্থান হতে পারে- কিংবা একটা বাড়িও হতে পারে।