*কুমারী পূজা কি এবং কেন করা হয়?
ছোট বেলা থেকেই রামায়ন ও মহাভারতে আমরা অনেক বড় বড় যজ্ঞের কথা শুনে এসেছি। কলি যুগের সব থেকে বড় যজ্ঞ হচ্ছে দুর্গোৎসব। এই দুর্গোৎসবের একটি বড় অঙ্গ হচ্ছে কুমারী পূজা। কুমারী পূজা নিয়ে আমাদের মধ্যে যেন কৌতূহলের কমতি নেই। ভারত ও বাংলাদেশের রামকৃষ্ণ মিশনসহ বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে অষ্টমীর মহাতিথিতে এই কুমারী পূজা হয়ে থাকে। শাস্ত্রকাররা নারীকে সন্মান ও শ্রদ্ধা করতে এই পূজা করতে বলেছেন। আমাদের সনাতন ধর্মে নারীকে সন্মানের শ্রেষ্ঠ আসনে বসানো হয়েছে। “নিজেদের পশুত্বকে সংযত রেখে নারীকে সন্মান জানাতে হবে”- এটাই কুমারী পূজার মূল লক্ষ্য।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ- এ রামের জন্য ব্রহ্মার দুর্গাপূজার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। তখন শরৎকাল, দক্ষিণায়ণ। দেবতাদের নিদ্রার সময়। তাই, ব্রহ্মা স্তব করে দেবীকে জাগরিত করলেন। দেবী তখন কুমারীর বেশে এসে ব্রহ্মাকে বললেন, বিল্মবৃক্ষমূলে দুর্গার বোধন করতে। দেবতারা মর্ত্যে এসে দেখলেন, এক দুর্গম স্থানে একটি বেলগাছের শাখায় সবুজ পাতার রাশির মধ্যে ঘুমিয়ে রয়েছে একটি তপ্তকাঞ্চন বর্ণা বালিকা। ব্রহ্মা বুঝলেন, এই বালিকাই জগজ্জননী দুর্গা। তিনি বোধন-স্তবে তাঁকে জাগরিত করলেন। ব্রহ্মার স্তবে জাগরিতা দেবী বালিকামূর্তি ত্যাগ করে চন্ডিকামূর্তি ধারন করলেন। তন্ত্রসার মতে, “১ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত বালিকারা কুমারী পূজার উপযুক্ত; তাদের অবশ্যই ঋতুমতি হওয়া চলবে না।” মেরুতন্ত্রে বলা আছে, “সর্বকামনা সিদ্ধির জন্য ব্রাহ্মণ কন্যা, যশোলাভের জন্য ক্ষত্রিয় কন্যা, ধনলাভের জন্য বৈশ্য কন্যা ও পুত্র লাভের জন্য শূদ্রকূল জাত কন্যা কুমারী পূজার জন্য যোগ্য।” গুণ ও কর্ম অনুসারেই এই জাতি বা বর্ণ নির্ধারিত হয়। সেইজন্যই প্রচলিত শাস্ত্র অনুসারে, বিভিন্ন মিশন ও মন্দিরগুলোতে সর্ব মঙ্গলের জন্য ব্রাহ্মণ কন্যাকেই দেবী জ্ঞানে পূজা করা হয়। সকল নারীর মধ্যই বিরাজিত রয়েছে দেবীশক্তি। তবে কুমারী রূপেই মা দুর্গা বিশেষভাবে প্রকটিত হয়েছিলেন। তাই, কুমারী রূপে নারীকে দেবীজ্ঞানে সন্মান জানানোর একটি বাস্তব উদাহরন হচ্ছে “কুমারী পূজা”।
*দুর্গা পূজা কেন করা হয়? মা দুর্গা, মা সরস্বতী, মা লক্ষ্মী, কার্তিক ও গণেশ - তাঁদের মধ্যে মূলত কিসের সম্পর্ক?
দুর্গা মূলত শক্তির দেবী। কখনও তিনি মহামায়া, কখনও বা উমা। কখনও আবার মহিষাসুরমর্দিনী। এমনই বহু নামে মর্তে পূজিত হন দেবী দুর্গা। শক্তির আধার দেবী দুর্গাকে আরাধনার মাধ্যমেই প্রতি বছর শারদীয়া উৎসবে মেতে ওঠে বাঙালি। কালিকা পুরাণ অনুযায়ী মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে স্বর্গরাজ্য দখল করেন। ব্রহ্মার বরে তিনি তখন অবধ্য। বিষ্ণু, শিব, ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতাদের সমবেত তেজ থেকে যে দুর্গা নামক নারীমূর্তি আবির্ভূত হয় সেই শক্তিই বিনাশ করে অসুরকে। ত্রেতাযুগে রাবণ চৈত্র মাসে এই পূজা করতেন। পরে পূজার নামকরণ হয়েছিল অকাল বোধন।
দুর্গার সঙ্গে আত্মীয়ের মত আরও যেসব দেবদেবী দেখা যায়-এরা হলেন- লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক গণেশ। ওপরের দিকে কখনও কখনও ছোট্ট করে শিবের মূর্তিও থাকে। প্রচলিত ধারণা আছে যে, এ যেন শিব দুর্গার সংসার, দুপাশে তাদের চারটি ছেলেমেয়ে! এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ওই চার জন মোটেই পরস্পরের ভাই বোন নন। আর, দুর্গার পক্ষেও কোনও সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় ছিল না।
সরস্বতী কী করে দুর্গার মেয়ে হবেন? তিনি দুর্গার চেয়েও বয়সে বড়। সরস্বতীর দেখা পাই আমরা আমাদের সভ্যতার ঊষালগ্নে, যখন ঋক বেদ রচিত হচ্ছে। তখন যজ্ঞের সময় এক সঙ্গে তিন দেবীকে আহ্বান করা হত। ইলা, ভারতী ও সরস্বতী। এরা প্রথমে আলাদা ছিলেন, এক সময় ইলা (ইড়া) কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন, আর, ভারতীও ক্রমশ মিশে গেলেন সরস্বতীর সঙ্গে। সরস্বতী দেবী আবার নদীরূপাও বটে। নামের অর্থেই তার পরিচয়। অবশ্য সরস শব্দের অন্য অর্থ জ্যোতি, অর্থাৎ তিনি জ্যোতির্ময়ী। ক্রমে নদীরূপটিই প্রাধান্য পায়। সে কালে গঙ্গার উল্লেখ খুবই কম, আর্য সভ্যতায় সিন্ধু এবং সরস্বতীই দুই প্রধান নদী। সরস্বতীর তীরে বহু যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত। প্রসিদ্ধ রাজারা এর দু’তীরে বাস করতেন। গড়ে উঠেছিল বহু নগর ও তীর্থস্থান। এক সময়ে কোনও অজ্ঞাত কারণে এই সরস্বতী নদী অর্ন্তহিত হয়ে যায়। পরিণত হয় মরুভূমিতে। তখন তিনি ছিলেন ধনদাত্রী, অন্নদাত্রী। দানশালিনী অন্নস্মপন্না স্তোতৃবর্গের রক্ষাকারিণী সরস্বতী যেন অন্নদ্বারা সম্যক রূপে আমাদের তৃপ্তি সাধন করেন।
আজকের যে সরস্বতীকে বাক দেবী বলে মনে করা হয়, আদি যুগে তিনি তা ছিলেন না। নদী রূপে তিনি মানুষের অন্ন ও সম্পদবৃদ্ধির জন্য আরাধ্যা হয়েছেন। আবার, দেবীরূপে তিনি যুদ্ধও করেছেন দানবদের বিরুদ্ধে। তখন লক্ষ্মীও আসেননি, দুর্গাও আসেননি। সরস্বতীর নানান গুণের কথা বলা হলেও তাঁর মূর্তি স্পষ্ট ছিল না। শুধু বলা হত তিনি শুভ্রবর্ণা।
লক্ষ্মীর আগমন আর একটু পরে। অনেকেরই ধারণা, সমুদ্রমন্থনের সময় উঠে আসেন লক্ষ্মী। কিন্তু, লক্ষ্মী সমুদ্রের অতলে গেলেন কী করে? এ সম্পর্কেও একটা কাহিনি আছে। দুর্বাসা মুনি, যিনি শুধু অভিশাপ দেবার জন্যই বিখ্যাত, তার অন্য কোনও গুণের কথা বিশেষ জানা যায় না, তিনি এক দিন একটা ফুলের মালা উপহার দিলেন ইন্দ্রকে। ইন্দ্র অমন ফুলের মালা অনেক পেয়েছেন, তিনি অন্যমনস্ক ভাবে মালাটি রেখে দিলেন ঐরাবতের মস্তকে। ঐরাবতের বোধহয় মালাটি পছন্দ হয়নি, মাথা ঝাঁকিয়ে সেটা সে ফেলে দিল মাটিতে। তার পর পা দিয়ে চেপ্টে দিল। ব্যস! রগচটা স্বভাবের ঋষি অমনি জ্বলে উঠে উচ্চারণ করলেন অভিশাপ। অদ্ভুত সেই অভিশাপ। তিনি বললেন, কী! আমার দেওয়া মালা মাটিতে ফেলে দিলে, তাই তোমার ত্রিলোক এখন লক্ষ্মীছাড়া হবে। অর্থাৎ, লক্ষ্মীর নির্বাসন। দোষ করলেন ইন্দ্র, শাস্তি পেতে হবে লক্ষ্মীকে। অগত্যা লক্ষ্মীকে লুকাতে হল সমুদ্রে। পরে দেবতাদের ব্যাকুল প্রার্থনায় বিষ্ণু পরামর্শ দিলেন সমুদ্র মন্থনের। মন্থনের পর যিনি রতœাকর থেকে উত্থিতা হলেন, তিনি কিন্তু লক্ষ্মী নন। সেই দেবীর নাম শ্রী। এই শ্রী ও লক্ষ্মী দুই পৃথক দেবী ছিলেন। বেশ কিছুকাল পরে দুজনে মিলেমিশে এক হয়ে যান।
আর দুর্গা তো কারও মা হতেই পারেন না। কয়েকটি পুরাণ মতে, তিনি শিবের স্ত্রীও নন। মহিষাসুর নামে অসুরকে ব্রহ্মা বর দিয়ে ফেলেছিলেন যে, কোনও পুরুষ তাকে বধ করতে পারবে না। এর পর সে মনের আনন্দে দেবতাদের ওপর অত্যাচার শুরু করল। উত্ত্যক্ত, ব্যতিব্যস্ত দেবতারা দেখলেন, এর একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার। তারা নিজেরা কেউ এই দানবের সঙ্গে লড়তে পারবেন না, এক প্রবল শক্তিশালিনী নারীকে সৃষ্টি করতে হবে। তখন অনেকেই তাদের তেজের অংশ দান করলেন এবং সেই তেজ থেকেই সৃষ্টি হলেন দেবী দুর্গা।
অবশ্য, বিভিন্ন পুরাণে এর ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা আছে। এই দেবীরই অন্য নাম চন্ডী ও কাত্যায়নী। কোনও কোনও অঞ্চলে কাত্যায়নী নামটিই বেশি জনপ্রিয়, বাংলায় দুর্গা।
হিন্দু দেবদেবীদের বিবর্তনের ইতিহাস, একের সঙ্গে অন্যদের মিশে যাওয়া ইতিহাস, যা খুবই আকর্ষণীয়। প্রশ্ন হলো, বিবর্তিত হতে হতে দেবদেবী কী তাহলে দুনিয়া থেকে উঠে যাবে? ভলতেয়ার বলেছিলেন, পৃথিবীতে যত দিন দারিদ্র থাকবে, তত দিন ধর্মকে একেবারে মুছে ফেলা যাবে না। দরিদ্র, অত্যাচারিত, অসহায় মানুষ যখন মনে করে তাকে সাহায্য করার আর কেউ নেই, কেউ তার পাশে দাঁড়াবে না, তখন সে মনে করে, আর কেউ না থাকুক, ঈশ্বর আছেন। সে ঈশ্বরকে আঁকড়ে ধরে শান্তি পায়। আর, দরিদ্র মানুষদের এই দুর্বলতা দেখে দেশের উচ্চ স্তরের মানুষ, যারা ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের ধার ধারে না, যারা ক্ষমতালোভী, তারা ধর্মের নানা রকম বিকৃতি ঘটিয়ে দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধায়। কথাটা আমাদের মতন দেশে এখনও অনেকটা সত্য।
শেষ কথা হলো, দুর্গাসহ তাঁর সহযোগী দেবদেবীর কাহিনি অত্যন্ত বৈচিত্রময় এবং রহস্যে ঘেড়া। বিভিন্ন দেবদেবীর সৃষ্টিতত্ত্ব মহাবিশ্বের মত; এ-ও যেন এক অনন্ত রহস্য!
© সংগৃহীত
[@প্রশ্নের উত্তর কিছুটা কাল্পনিক মনে হচ্ছে।
প্রশ্ন থাকলেও যথার্থ উত্তর পাই নাই৷
কারো নিকট এই প্রশ্নের আরো সমৃদ্ধ উত্তর থাকলে আমাদের জানানোর জন্য অনুরোধ করছি।]